Summary
ভাষা আন্দোলনের পটভূমি:
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগে ভাষা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। ১৯৩৭ সালে উর্দুকে দাপ্তরিক ভাষা করার প্রস্তাবের বিরুদ্ধে বাঙালিরা প্রতিবাদ জানায়। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর উর্দু রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব প্রতারণার মতো দেখা যায়, যার বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার বুদ্ধিজীবীরা লেখালেখি করে প্রতিবাদ জানায়। ১৯৪৮ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার দাবিতে ধর্মঘট পালিত হয় এবং ২রা মার্চ রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন গড়ে ওঠে।
রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ:
১৯৪৮ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আন্দোলন সংগঠিত হয়। ১৫ই মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী ৮ দফা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন, যা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিকে সমর্থন করে।
জিন্নাহর বক্তব্য ও আন্দোলন:
১৯৪৮ সালে ঢাকায় জিন্নাহ উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা বলে ঘোষণা করেন, যা ছাত্র সমাজের প্রতিবাদের জন্ম দেয়। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে পুলিশের গুলিতে শহীদ হয় কয়েকজন ছাত্র। এর ফলে ভাষা আন্দোলন আরও গতি পায় এবং ছাত্র সমাজ মামলা ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে অংশ নেয়।
ভাষা আন্দোলনের ফল ও জাতীয়তাবাদের উন্মেষ:
শহীদ দিবস ২১শে ফেব্রুয়ারি এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত হয়। এই আন্দোলন বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি রচনা করে এবং স্বাধীনতার পক্ষে সচেতনতা তৈরি করে। ১৯৫৬ সালে বাংলা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
শিক্ষার গুরুত্ব:
বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির ফলে পূর্ব বাংলার জনগণের মধ্যে আত্মসম্মান সৃষ্টি হয় এবং তারা নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষায় সচেতন হয়ে ওঠে।
ভাষা আন্দোলনের পটভূমি
পাকিস্তান সৃষ্টির আগেই এই রাষ্ট্রের ভাষা কী হবে তা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। ১৯৩৭ সালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ মুসলিম লীগের দাপ্তরিক ভাষা উর্দু করার প্রস্তাব করলে বাঙালিদের নেতা শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক এর বিরোধিতা করেন। ১৯৪৭ সালের এপ্রিল মাসে পাকিস্তান নামক একটি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা যখন প্রায় নিশ্চিত হয়ে যায়,তখনই বিতর্কটি পুনরায় শুরু হয়। ১৯৪৭ সালের ১৭ই মে চৌধুরী খলীকুজ্জামান এবং জুলাই মাসে আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিন আহমদ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব দেন। তাদের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার ভাষাবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এবং ড. মুহাম্মদ এনামুল হকসহ বেশ ক'জন বুদ্ধিজীবী প্রবন্ধ লিখে প্রতিবাদ জানান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল কাশেমের নেতৃত্বে ২রা সেপ্টেম্বর ১৯৪৭ তমদ্দুন মজলিস নামক একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। ৬–৭ই সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত উক্ত সংগঠনের যুবকর্মী সম্মেলনে ‘বাংলাকে শিক্ষা ও আইন আদালতের বাহন' করার প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসে করাচিতে অনুষ্ঠিত এক শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে পূর্ব বাংলায় তীব্র প্রতিবাদ শুরু হয়। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি ওঠে, লেখালেখি শুরু হয়। ডিসেম্বর মাসেই ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ' গঠিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সচিবালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে মিছিল, সভা-সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। পাকিস্তান সরকার ১৪৪ ধারা জারিসহ সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ১৯৪৮ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত গণপরিষদের ভাষা হিসেবে উর্দু ও ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা ব্যবহারের দাবি জানান। তাঁর দাবি অগ্রাহ্য হলে ২৬ ও ২৯শে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ধর্মঘট পালিত হয়। ২রা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ' পুনর্গঠিত হয়। এ সংগঠন ১১ই মার্চ ‘বাংলা ভাষা দাবি দিবস' পালনের ঘোষণা দেয় । ঐ দিন সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়। ১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ এ কর্মসূচি পালনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই' স্লোগানসহ মিছিল ও পিকেটিং করা অবস্থায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল হক ও অলি আহাদসহ ঊনসত্তর জনকে গ্রেফতার করা হয়। নব প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাংলা ভাষার জন্য প্রথম রাজবন্দিদের শীর্ষস্থানীয় ছিলেন তৎকালীন ছাত্রনেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান । গ্রেফতার নির্যাতনের প্রতিবাদে ঢাকায় ১২-১৫ই মার্চ ধর্মঘট পালিত হয়। বাধ্য হয়ে পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন ১৫ই মার্চ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে ৮ দফা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।
দফাগুলো নিম্নে উল্লেখ করা হলো।
১. বাংলা ভাষার প্রশ্নে গ্রেপ্তারকৃত সকলকে অবিলম্বে মুক্তি দান করা হবে।
২. পুলিশি অত্যাচারের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং তদন্ত করে একটি বিবৃতি প্রদান করবেন।
৩. বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার জন্য পূর্ব বাংলার আইন পরিষদে একটি বিশেষ প্রস্তাব উত্থাপন করা হবে। ৪. পূর্ববাংলার সরকারি ভাষা হিসেবে ইংরেজি উঠে যাওয়ার পর বাংলাকে সরকারি ভাষা হিসেবে প্রবর্তন করা হবে।
শিক্ষার মাধ্যমও হবে বাংলা।
৫. সংবাদপত্রের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হবে।
৬. আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না । ৭. ২৯শে ফেব্রুয়ারি হতে জারিকৃত ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার করা হবে।
৮. রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন 'রাষ্ট্রের দুশমনদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয় নাই'-এ মর্মে মুখ্যমন্ত্রী ভুল স্বীকার করে বক্তব্য দেবেন।
১৯৪৮ সালের ১৯শে মার্চ পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় আসেন। ২১শে মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) অনুষ্ঠিত জনসভায় তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেন,‘উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা'। ২৪শে মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমাবর্তনেও তিনি অনুরূপ ঘোষণা দিলে ছাত্র সমাজ প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে এবং ‘না, না বলে তাঁর উক্তির প্রতিবাদ জানায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জিন্নাহর রেসকোর্স ময়দানের ঘোষণারও তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ জানিয়েছিল। একপর্যায়ে পাকিস্তান সরকার আরবি হরফে বাংলা প্রচলনের উদ্যোগ নিয়েছিল। বাঙালিরা এ অপপ্রয়াসের তীব্র ক্ষোভ ও প্রতিবাদ জ্ঞাপন করে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অল্প কয়েক মাসের মধ্যেই পূর্ব বাংলায় ভাষাকেন্দ্রিক যে আন্দোলন শুরু হয়, তা ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতি আস্থার বহিঃপ্রকাশ। মাতৃভাষা বাংলাকে রক্ষার মাধ্যমে পূর্ব বাংলার জনগণ জাতীয়ভাবে নিজেদের বিকাশের গুরুত্ব উপলব্ধি করে। এ ভূখণ্ডে বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলো রাষ্ট্রভাষা উর্দু নয় বরং বাংলাকেই সমর্থন করে।
১৯৫২ সালের ২৬শে জানুয়ারি ঢাকার পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন জিন্নাহর অনুকরণে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার নতুন ঘোষণা প্রদান করেন। এর প্রতিবাদে ছাত্র সমাজ ৩০শে জানুয়ারি ধর্মঘট পালন করে। আবদুল মতিনকে আহ্বায়ক করে ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ' গঠিত হয়। ৩১শে জানুয়ারি কাজী গোলাম মাহবুবকে আহ্বায়ক করে নতুনভাবে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। ফলে আন্দোলন আরও বেগবান হয়। এর সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোও যুক্ত হয়। ৪ঠা ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্র বিক্ষোভ প্রদর্শিত হয়। ২১শে ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট এবং ঐদিন রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
ভাষার দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার সংকল্প ঘোষণা করা হয়। কারাবন্দি নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় ২১শে ফেব্রুয়ারির কর্মসূচি পালনে ছাত্র ও আওয়ামী মুসলিম লীগের নেতা-কর্মীদের ডেকে পরামর্শ দেন। ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদানের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও সহবন্দি মহিউদ্দিন আহমেদকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ফরিদপুর জেলে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে মহিউদ্দিন আহমেদকে সঙ্গে নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাজবন্দিদের মুক্তি ও রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আমরণ অনশন শুরু করলে আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে। দেশব্যাপী জনমত গড়ে উঠতে থাকে। ২০শে ফেব্রুয়ারি সরকারি এক ঘোষণায় ২১শে ফেব্রুয়ারি থেকে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। সভা সমাবেশ, মিছিল এক মাসের জন্যে নিষিদ্ধ করা হয়। আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ২১শে ফেব্রুয়ারি সকাল ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় (বর্তমান ঢাকা মেডিকেল কলেজের জরুরি বিভাগের পাশে ) একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ১০ জন করে মিছিল বের করার সিদ্ধান্ত হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজের দিক থেকে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল এগিয়ে চলে। মিছিলের অগ্রভাগে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীগণ। সাথে ছিলেন ইডেন কলেজ, কামরুন্নেসা গার্লস স্কুল ও বাংলা বাজার গার্লস স্কুল হতে আগত ছাত্রীগণও । পুলিশ প্রথমে কয়েকজনকে গ্রেফতার করে, মিছিলে লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। একপর্যায়ে পুলিশ গুলি বর্ষণ করলে আবুল বরকত, জব্বার, রফিক, সালামসহ আরও অনেকে শহিদ হন। অনেকে আহত হন। ঢাকায় ছাত্রহত্যার খবর দ্রুত সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ২২শে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় বিশাল শোক র্যালি বের হয়। সেখানে পুলিশের হামলায় শফিউর রহমান শহিদ হন ।
শহিদদের স্মৃতি অমর করে রাখার জন্য ঢাকায় ২৩শে ফেব্রুয়ারি ছাত্র-জনতা মেডিকেল কলেজের সামনে একটি শহিদ মিনার নির্মাণ করে এবং শফিউরের পিতাকে দিয়ে ঐ দিনই তা উদ্বোধন করা হয়। ২৪ তারিখ পুলিশ উক্ত শহিদ মিনার ভেঙ্গে ফেলে। ঢাকায় ২১শে ফেব্রুয়ারি ছাত্রহত্যার প্রতিবাদে চট্টগ্রামে কবি মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি' শীর্ষক প্রথম কবিতা রচনা করেন। তরুণ কবি আলাউদ্দিন আল আজাদ ‘স্মৃতির মিনার' কবিতাটি রচনা করেন। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, রাজশাহী, রংপুর, খুলনা, বরিশাল, কুমিল্লাসহ বিভিন্ন শহরে ছাত্র, যুবকসহ সাধারণ মানুষ ভাষার দাবিতে আন্দোলনের প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতি ঘৃণা পোষণ শুরু করে। এসব হত্যাকাণ্ড পূর্ব বাংলার জনগণের মনের ওপর বড় ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী রচনা করেন ‘আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি'। সঙ্গীতশিল্পী আবদুল লতিফ রচনা ও সুর করেন “ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়', এবং ‘তোরা ঢাকা শহর রক্তে ভাসাইলি'র মতো সঙ্গীত। ড. মুনীর চৌধুরী জেলে বসে রচনা করেন 'কবর' নাটক। জহির রায়হান রচনা করেন ‘আরেক ফাল্গুন' উপন্যাসটি। ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে পূর্ব বাংলায় শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চায় পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনা মূলধারার রাজনৈতিক আদর্শ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ স্থান করে নেয় ৷
১৯৪৭ সালে সূচিত রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ সালে প্রতিবাদ ও রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে রূপ লাভ করে। ফলে পাকিস্তান সরকার বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের সংবিধানে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। নিজের ইতিহাস, ঐতিহ্য, ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে পূর্ব বাংলার বাঙালি এবং অন্যান্য জনগোষ্ঠী মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর সাহস ও আত্মপ্রত্যয় খুঁজে পায়। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর পঞ্চাশের দশকব্যাপী ছিল বাঙালিদের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রস্তুতিকাল। ভাষা আন্দোলন পরবর্তীকালে সকল রাজনৈতিক আন্দোলনের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছি। এ আন্দোলন এ দেশের মানুষকে তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে তোলে। বাঙালিদের মধ্যে ঐক্য ও স্বাধীনতার চেতনা জাগিয়ে তোলে। পাকিস্তানি শাসনপর্বে এটি বাঙালিদের জাতীয় মুক্তির প্রথম আন্দোলন।
জাতীয়তাবাদের উন্মেষ
বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশে ভাষা আন্দোলন সকলকে ঐক্যবদ্ধ করে। পাকিস্তানের প্রতি আগে যে মোহ ছিল তা দ্রুত কেটে যেতে থাকে। নিজস্ব জাতিসত্তা সৃষ্টিতে ভাষা ও সংস্কৃতির সম্পর্ক এবং গুরুত্ব পূর্ব বাংলার মানুষের কাছে অধিকতর স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বাঙালি হিসেবে নিজেদের আত্মপরিচয়ে রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি গড়ে তোলার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে থাকে। ভাষাকেন্দ্রিক এই ঐক্যই জাতীয়তাবাদের মূল ভিত্তি রচনা করে, যা পরবর্তী সময়ে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
শহিদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস
১৯৫৩ সাল থেকে ২১শে ফেব্রুয়ারি ‘শহিদ দিবস' হিসেবে দেশব্যাপী পালিত হয়ে আসছে। প্রতি বছর ২১শে ফেব্রুয়ারি খালি পায়ে হেঁটে শহিদ মিনারে ফুল অর্পণ করে আমরা শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। বাঙালি জাতির কাছে দিনটি গভীর শোকের চেতনায় উজ্জীবিত হওয়ার দিন। কানাডাভিত্তিক বহুভাষিক ও বহুজাতিক মাতৃভাষা-প্রেমিক গোষ্ঠীর সদস্য রফিকুল ইসলাম ও আব্দুল সালামের উদ্যোগ এবং আওয়ামী লীগ সরকারের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও কূটনৈতিক তৎপরতার ফলে ১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ইউনেস্কো বাংলাদেশের ২১শে ফেব্রুয়ারির শহিদ দিবসকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' (International Mother Language Day) হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। পৃথিবীতে ৬০০০ এর বেশি ভাষা রয়েছে। এসব ভাষার মানুষ সেই থেকে বাংলাদেশের শহিদ দিবসের গুরুত্ব উপলব্ধি করে নিজেদের ভাষার মর্ম নতুনভাবে বুঝতে শিখেছে। আমাদের দেশে বাংলাভাষীদের পাশাপাশি বিভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির নৃগোষ্ঠী রয়েছে। বর্তমান সরকার সকল নৃগোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতির সংরক্ষণ এবং উন্নয়নে সচেষ্ট হয়ে মাতৃভাষায় আনুষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণে সুযোগ সৃষ্টি করেছে।
Read more